Ray Netflix Review :
সত্যজিত রায়কে নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই ঘুরেফিরেই বাঙালির আলোচনায়, পড়াশোনায়, ভাবনা চিন্তায় তিনি বিরাজমান। সত্যজিত বাবুর গল্পগুলি এখনও মাঝবয়সী আদ্যোপান্ত কর্পোরেট চাকুরিজীবী থেকে শুরু করে ক্লাস সিক্সের পল্টু সকলকে সমান ভাবে রোমাঞ্চিত করে। তাই পৃথিবী বিখ্যাত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে (Netflix) সত্যজিত রায়ের চারটি ছোট গল্প নিয়ে তৈরী অ্যানথ্রোলজি Ray কে নিয়ে বাঙালির যে বাড়তি আগ্রহ থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
Ray এর নির্মাতারাঃ
তিনজন আলাদা আলাদা পরিচালক মিলে এই অ্যানথ্রোলজি সিরিজটি বানিয়েছেন।
সৃজিত মুখার্জি- ফরগেট মি নট ( মূল গল্পঃ বিপিন চৌধুরির স্মৃতিভ্রম)
বহুরূপীয়া ( মূল গল্পঃ বহুরূপী)
অভিষেক চৌবে- হাঙ্গামা হ্যা কিউ বারপা ( মূল গল্পঃ বারিন ভৌমিকের ব্যারাম)
ভাসান বালা- স্পটলাইট ( মূল গল্পঃ স্পটলাইট)
Ray এর প্রথম গল্প ‘ফরগেট মি নট’
জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক সৃজিত মুখার্জি এই গল্পটি পরিচালনা করেছেন। অভিনয়ে রয়েছেন আলি ফজল, অনিন্দিতা বোস, শ্বেতা বসু প্রসাদ এবং অন্যান্যরা। ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’ গল্পটিকে আজকের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন পরিচালক। গল্পের ন্যারেটিভ তিনি খুব বেশি কিছু বদলাননি, তবে আজকের দিনে উপস্থাপন করতে গিয়ে যেটুকু আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে হয়েছে সেটুকুই। মূল প্রটাগনিস্ট ইপ্সিত রমন (আলি ফজল)। বিজনেস টাইকুন ইপ্সিত কীভাবে হঠাত করেই সব ভুলে যাচ্ছে, আচমকা তার জীবনে নেমে আসছে অনিশ্চয়তা এবং নিজের অজান্তেই সে জড়িয়ে পড়ছে দুর্ভেদ্য ষড়যন্ত্রের জালে তা নিয়েই এই ছবিটি।
প্রত্যেকের অভিনয় শৈলী নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই তবে আরো একটু ছোট হলে মন্দ হতনা। অহেতুক বড় করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অনিন্দিতা বোস খুবই ভালো কিন্তু গোটা গল্পে তাকে খুব বেশি সময়ের জন্য আমরা পাইনা। এই গল্পটির ক্ষেত্রে আলাদা করে যেটি অবশ্যই বলার সেটি হল ক্লাইম্যাক্সে একটি বড় ওয়ান টেক শট এবং সেই শটের মধ্যেই যেভাবে চরিত্রগুলির আসল গল্প ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। পরিচালক সহ গোটা টিমই অসাধারণ কাজ করেছে এখানে। সাউন্ড ডিজাইনের সাহায্যেও গল্প বলার চেষ্টা করেছেন পরিচালক তবে চিত্রনাট্য আরো ভালো হতে পারতো।
Ray এর দ্বিতীয় গল্প বহুরুপীয়া
এই গল্পটিও পরিচালনা করেছেন সৃজিত মুখার্জি। এই গল্প দেখতে দেখতে একটা সময়ের পর আপনার মনে হতে পারে পরিচালকের অন্য ছবি ‘ভিঞ্চি দা’ দেখছেন। কারণ দুটির মধ্যেই সামঞ্জস্য সহজেই চোখে পড়বে যা অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে। এই গল্পের ক্ষেত্রেও পরিচালক নিজস্ব কিছু যোগ করেননি, গল্প থেকেই সবটা নিয়েছেন তবে শুরুর দিকে কোন সময়কে পরিচালক দেখাচ্ছেন তা একটু গুলিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে অযাচিত যৌনতা দেখানো হয়েছে যার কোন দরকার ছিলনা। মোটের ওপর উপস্থাপনার দিকে থেকে বড়ই দুর্বল। ইন্দ্রাশিস (কে কে মেনন) চরিত্রটি নিয়ে আরো অনেক কিছু করতে পারতেন পরিচালক, চরিত্রটির কিছু শেডস বের করে আনতে পারতেন তবে সেসব দিকে খামতি আছে।
Ray এর তৃতীয় গল্প হাঙ্গামা হ্যা কিউ বারপা
‘বারিন ভৌমিকের ব্যারাম’ গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিচালক অভিষেক চৌবে এই ছবিটি বানিয়েছেন। যেখানে আগের দুটি ছবির মতো সবটাই গল্পের অনুকরণে চিত্রনাট্য লেখা হয়নি। নিজের মতো করে ন্যারেটিভ বা গল্প বলেছেন পরিচালক। অবশ্যই এই ছবির মূল আকর্ষন মুসাফির আলি (মনোজ বাজপেয়ী) যিনি একজন গজল গায়ক। মুসাফির ট্রেনে করে ভোপাল থেকে দিল্লি আসছেন। অন্যদিকে রয়েছেন অপর এক দিগগজ অভিনেতা গজরাজ রাও যিনি ছবিতে আসলাম বেগ এর চরিত্রে অভিনয় করছেন।
ডার্ক হিউমার নিয়ে যদি আপনি উতসাহিত হন তাহলে অবশ্যই এই ছবিটি আপনাকে অন্যভাবে আকর্ষণ করবে। সাথে ছবির ট্রিটমেন্টও বেশ অন্যরকম। একই স্ক্রিনে যখন দুই মহীরুহ অভিনেতা অভিনয় করেন তখন আখেরে লাভ তো দর্শকেরই হয়।
Ray এর চতুর্থ গল্প স্পটলাইট
ভাসান বালা পরিচালিত এই গল্পটি বাকিগুলির থেকে অনেকাংশে আলাদা। সত্যজিত রায়ের ‘স্পটলাইট’ গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হলেও বাকিটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন পরিচালক। সুপারস্টার অভিনেতা ভিকের (হর্ষবর্ধন কাপুর) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ, নিরাপত্তাহীনতা, যশ প্রতিপত্তির আড়ালে ক্যামেরার পিছনে তার জীবন এই সবকিছুই ‘নায়ক’ ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার দিদির (রাধিকা মদন) জীবনের গল্প, সংগ্রাম, প্রতিপত্তির মধ্যে আমরা সত্যজিত রায়ের ‘দেবী’ এবং ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ এর ছাপ দেখতে পাই।
হর্ষবর্ধন কাপুর নিজের অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন পাশাপাশি গোটা ছবি জুড়েই সত্যজিত রায়ের নানান সৃষ্টির ছোঁয়া পাওয়া যায়। ডায়লগ থেকে শুরু করে টিশার্ট সবকিছুতেই রয়েছেন রায়বাবু। দর্শক হিসেবে এই বিষয়টি আপনার ভালো লাগতেই পারে। ছবির একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই ভিক তার মা কে নিয়ে হ্যালুসিনেট করছে এবং তার পেছনে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবির সেই নস্টালজিক লাইট। পরিমিত কমেডিও রেখেছেন পরিচালক। সবমিলিয়ে বাকি তিনটি ছবির থেকে ‘স্পটলাইট’ কিছুটা আলাদা এবং বেশ ভালো।
উপসংহার
সত্যজিত রায় একা বা সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের গল্প বলতে ভালোবাসতেন। Ray সিরিজের চারটি গল্প মূলত চারজন পুরুষকে কেন্দ্র করে পরিলক্ষিত। আলি ফজল, কে কে মেনন, মনোজ বাজপেয়ী এবং হর্ষবর্ধন কাপুর চারজনেই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন যদিও তুল্যমূল্য বিচারে হয়তো কে কে মেনন একটু পিছিয়ে থাকবেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি কতটা জায়গা পেয়েছেন সেটাও মাথায় রাখতে হবে। বাকি তিনজন পোড় খাওয়া অভিনেতাদের মাঝে হর্ষবর্ধন কাপুরের জায়গাটা খুব একটা সহজ ছিলনা তবে তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের মতো করে। সবমিলিয়ে প্রায় চার ঘন্টার এই সিরিজটি ভালো খারাপের সংমিশ্রণে আপনাকে সত্যজিত রায়ের সৃস্টিকে নতুন ভাবে ভাবার জন্য, বোঝার জন্য উতসাহিত করবে সেকথা বলাইবাহুল্য।