হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়েই মনটা একবার যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল। শ্যামলী হাসপাতালে ভর্তি। বছর তিনেক আগে আমাদের বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে। বিয়ের আগেই শ্যামলীর বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম তিন লাখ টাকা দেবার জন্য। ভেবেছিলাম সেই টাকায় একটা ছোট্ট ব্যবসা দাঁড় করাতে পারব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনি সেই টাকাটা জোগাড় করে উঠতে পারেননি। তারপর অনেক চেষ্টা করেও আর শ্যামলীকে ভালোবাসতে পারিনি। মেয়েটাকে দেখতে নেহাত মন্দ ছিলনা, গায়ের রঙটা চাপা, তবুও কথা দিয়ে কথার খেলাপ করাটা মেনে নিতে পারিনি…
এরপর বেশ কিছুদিন এগিয়েছে। শ্যামলীও বুঝে গেছিল আমার থেকে ভালোবাসা পাওয়ার আশা নেই। সে বিশেষ কিছু বলতে পারতনা। সকাল সন্ধ্যে রান্না করত, কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে খাবার এগিয়ে দিত, স্ত্রী হিসাবে এতটুকুই ছিল ওর অধিকার। একসাথে শুতে দিতাম না, নীচু বর্ণের মেয়ে। টাকাটা পেলে হয়ত তাও সমঝোতা করার কথা ভাবতাম।
একদিন সে প্রস্তাব করেছিল অন্যের বাড়িতে বাসন মেজে আমার জন্য তিন লাখ টাকা জোগাড় করে দেবে। শুনে রাগের চোটে গায়ে হাত তুলে দিয়েছিলাম। অবশ্য এটা প্রথমবার নয়, আগেও কাজের ক্ষেত্রে কোনো গণ্ডগোল হলে বাড়ি ফিরে শ্যামলীকে মারতাম। সে প্রতিবাদ করতনা দেখে রাগটা আরও বেড়ে যেত। সে অনেকবার আমার সমস্যা ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু কোনোদিন ওকে কিছু বলার কথা ভাবিনি। যেই মেয়ে মার খেয়ে চুপচাপ চোখের জল ফেলতে জানে, সে আমার সমস্যা কিভাবে ভাগ করে নেবে? ওকে বাপের বাড়ি যেতে দিতাম না। শর্ত ছিল যদ্দিন না ওর বাবা পুরো টাকাটা দিতে পারছে ততদিন মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবেনা।
অবশেষে দেখতে দেখতে তিনবছর কেটে গেছে। গতমাসে একবার শ্যামলীর খুব জ্বর হয়। সেদিন প্রথম ওকে বলেছিলাম রাতে আমার পাশে শুতে। মাথায় জলপট্টি লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ও আমার হাত ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেদে ফেলেছিল। সেদিন খুব ইচ্ছে হয়েছিল মেয়েটাকে বুকে টেনে নিতে। কিন্তু এতদিন যা করিনি, আজও তা আবেগের বশে করলাম না।
ডাক্তারের টেস্টে ধরা পড়ল শ্যামলীর ব্লাড ক্যানসার হয়েছে। লাস্ট স্টেজ। শ্যামলীকে একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলাম। প্রথমবার ঠাকুরের কাছে খুব কেঁদেছিলাম। বলেছিলাম একটা সুযোগ দিতে সব ভুল শুধরে নেবার।
হঠাত ডাক্তারের ডাকে চমক ভাঙল। এগিয়ে গেলাম শ্যামলীর বেডের দিকে। ওর পাশে বসে মাথায় হাত রাখলাম। শ্যামলী ছলছল চোখে আমার হাতটা চেপে ধরে অতিকষ্টে বলল, “এজন্মে না হোক, পরের জন্মে আমায় ভালোবাসবেন তো?” আর নিজেকে চেপে রাখতে পারলাম না। শ্যামলীকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেললাম। বললাম, “ক্ষমা করে দাও শ্যামলী, একটা সুযোগ দাও, খুব ভালোবাসব তোমায়। এভাবে ছেড়ে যেওনা।”
শ্যামলী কোনো উত্তর দিলনা, চোখের পাতাও ফেলল না। শুধু চোখের কোন দিয়ে এক ফোঁটা জল বেড়িয়ে এল। এতদিন যে কথাগুলো সে মুখ ফুটে বলতে পারেনি, আজকেও পারলনা। শুধু যাবার আগে শিখিয়ে দিয়ে গেল ভালোবাসার আসল মানে…