মাঝ রাতে রিয়ার বাড়ি থেকে ফোন পেয়েই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমার রিয়া হাসপাতালে ভর্তি। আলুথালু ভাবে ঘরের পোশাক পরিধিত অবস্থাতেই উবের ক্যাব বুক করে রওনা দি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আমায় দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ে রিয়ার মা। “রিয়া হয়ত আর বাঁচবেনা”। কথাগুলো রিয়ার মা যত না জোরে বলল, তার চেয়েও জোরে যেন বাজ পড়ল আমার বুকে। হাঁটু গেড়ে ওখানেই বসে পড়লাম।”
রিয়ার সাথে আমার স্কুল জীবনের প্রেম। ওর গজদাঁতের মিষ্টি হাসি দেখে প্রেমে পড়ে যাই ওর। এখনও মনে আছে, গিটারে সুর তুলে গান গেয়ে মনের কথাটা জানিয়েছিলাম আর রিয়াও মিষ্টি হেসে সম্মতি জানিয়েছিল। পাঁচ বছর টানা সম্পর্ক চলার পরে দুজনে চাকরি পাই, আমাদের সম্পর্কটাও পরিণত হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নি বাড়ির লোকদের সম্পর্কের কথা জানানোর। উভয়েরই বাড়ির লোক সম্মতি দেয় আমাদের বিয়েতে। একদিন প্রিন্সেপ ঘাটে নৌকায় চেপে দুজনে অনেক স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করি। সারাজীবন একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার করি। তবে ভগবান হয়ত চেয়েছিলেন আমাদের সুখের মাঝে একটি প্রাচীর সৃষ্টি করার। মানুষের জীবনে যখনই সব ঠিক চলে, তখনই ঈশ্বর ঝড় সৃষ্টি করে সবকিছু তছনছ করে দেয়।
আমাদের বিয়ের দিন দেখা হয়ে গেছিল। বাড়ির সকলের খুশির কূলকিনারা ছিলনা। সে সময়েই এমন এক ঘটনা ঘটে, যা আমাদের দুজনের জীবনকেই আমূল বদলে দেয়। কিছু মাস আগে রিয়া বান্ধবীর সাথে বেড়িয়েছিল। সন্ধ্যের দিকে অন্ধকার গলিতে একটি মেয়ের অস্ফুট আর্তনাদ শুনতে পেয়ে সচকিত হয়। এগিয়ে গিয়ে দেখে একটি স্কুলের পোশাক পরিধিতা কিশোরী মেয়েকে দুজন যুবক জোর করে জামা ছিঁড়ে দেবার চেষ্টা করছে। অপরজন মেয়েটির মুখ চেপে ধরে আছে যাতে সে চিৎকার করতে না পারে। রাস্তা দিয়ে দু’একজন পুরুষ যাতায়াত করলেও ঘটনাটি অগ্রাহ্য করেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় তারা। কিন্তু রিয়া চুপ থাকতে পারেনা। গিয়ে সপাটে একজন যুবকের গালে চড় কষায়। অপরজন যুবক কিশোরীকে ছেড়ে রিয়াকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলেই চকিতে ওর তলপেটে লাথি কষায় রিয়া। স্কুল জীবনে ক্যারাটে শিখেছিল, আজ কাজে লেগে যায়। আর এসব ব্যাপারে রিয়া ছিল রীতিমত সিদ্ধহস্ত। রিয়াকে এভাবে প্রতিবাদ করতে দেখে রাস্তায় চলা বাকী মানুষরাও ওর পাশে দাঁড়ায়। বেগতিক দেখে যুবকদ্বয় দৌড় লাগায়, আর যাবার সময় চিৎকার করতে থাকে “দেখে নেব তোকে।” অগত্যা স্কুল ড্রেস পরা কিশোরীর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে ওকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসে রিয়া আর তার বান্ধবী।
পরের দিন এসব ঘটনা শুনে আমি রীতিমত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। চোখে চোখে রাখতে থাকি রিয়াকে, যাতে ওর কোনো বিপদ না ঘটে। ইতিমধ্যে দুমাস কেটে যায়। আমাদের বিয়ের আয়োজন শুরু হতেই পুরোনো কথাগুলো ভুলে যাই সব। সেদিন রিয়া অফিস থেকে রাতে বাড়ি ফিরছিল। তখনই ঘটে যায় রিয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। বাইকে করে আসা চারজন ছেলে অ্যাসিড ভর্তি বাল্ব ছুঁড়ে মারে রিয়ার মুখে। মুহুর্তের মধ্যে ঝলসে যায় রিয়ার একটা চোখ সমেত বাকী মুখের চামড়া। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে রাস্তায় বসে আর্তনাদ করতে থাকে সে। রাস্তায় রীতিমত ভিড় জমে গেলেও কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি বরং কয়েকজন মোবাইলে ভিডিও করতে থাকে। অবশেষে একজন বৃদ্ধ দয়াবান ব্যক্তি অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলে সেই রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রিয়াকে।
মাস খানেক পর রিয়ার মুখের ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হয়। হাসপাতালে রিয়ার পাশে বসলে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। খানিক্ষণ চুপ থাকার পরে বলে, “আমি তোকে বিয়ে করতে পারবনা রে, ক্ষমা করে দিস আমায়।” মুখ তুলে জানতে চাই, “কেন রিয়া?” রিয়া বলে, “আমি আর তোর আগের রিয়া নই। আমি শেষ হয়ে গেছি। চাইনা তোর জীবনটাও শেষ হয়ে যাক। লোকে সারাজীবন তোর ওপর হাসবে। একজন সুন্দরী মেয়ে খুঁজে নিস। ভুলে যাস আমায়”। কান্না চাপতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় রিয়া।
আমার চোখ দিয়ে অঝোরে টপটপ করে জল ঝরতে থাকে নিজের অজান্তেই। তবুও নিজেকে সংবরণ করে রিয়ার হাতটা আমার মুঠিতে পুরে বলি, “তুই আমার সেই আগের রিয়াই আছিস। সেই আগের মতই সুন্দরী। ওরা তোর রূপ বিকৃত করতে চেয়েছিল কিন্তু হাসিটা বিকৃত করতে পারেনি। এই হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিলাম কিনা।” এত দুঃখের মধ্যেও রিয়া হেসে ফেলে। কান্না জড়ানো গলায় বলে, “আমায় ভালবাসবি তো আগের মতই?” রিয়ার কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলি, “আগেও বাসতাম, এখনও বাসি, সারাজীবন বাসব। বৃদ্ধ বয়সে দুজনে একসাথে হাতে হাত রেখে মরার কথা দিয়েছিলাম যে।”
অ্যাসিড ছুঁড়ে মারা ছেলেগুলি ছয় বছরের সশ্রম কারাদন্ডের শাস্তি পেয়েছিল। অপরাধের তুলনায় অনেক কম শাস্তি হলেও আমি প্রতিশোধের বদলে রিয়ার জীবনকে নতুন খুশির আঙ্গিকে মুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। রিয়ার মত হাজার হাজার মেয়ে প্রতিদিন প্রতিহিংসার শিকার হয়, অ্যাসিড আক্রান্ত হয়ে গোটা জীবনটা বর্বাদ করে ফেলে। তাই রিয়াকে সুখী করে আমি তাদেরকে বোঝাতে চেয়েছিলাম যে প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসাই পারে সবকিছু বদলে দিতে।
আজ বছর ছয়েক হল আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। আমাদের পরিবার হাসি মুখেই সম্পর্কটাকে মেনে নিয়েছে। এর মধ্যে একটি বারও রিয়াকে বুঝতে দি নি যে ও বাকীদের তুলনায় আলাদা। আমাদের ভালোবাসাটা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে বৈ কমেনি। বিয়ের বছর খানেক অবধি রিয়া প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠত। ওর মনে পড়ে যেত অতীতের ভয়ানক স্মৃতিগুলো, আর নিজেকে ও সেই মুহুর্তে আমার জীবনের বোঝা মনে করত। তখন আমি রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বস্ত করতাম ওকে। আজ রিয়া নিজের অতীত ভুলতে বসেছে। আমাদের একটি বছর চারেকের ফুটফুটে মেয়ে আছে, দুজনের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে ওর নাম দিয়েছি সায়রি… অফিসের পার্টি হলে রিয়াকে নিয়ে যাই, এখনও আমরা হাত ধরে শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াই, গিটারে সুর তুলে ওকে গান শোনাই, ঝগড়া করি মান ভাঙাই ঠিক আগের মতই। প্রেমে রূপ নয়, ভালোবাসার মানুষটির সাথটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ একথা আমরা দুজনেই বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি। রিয়ার জীবন শেষ করার চেষ্টা করা ছেলেগুলোকে আমরা ব্যর্থ প্রমাণ করেছি, কেননা আমরা দুজনে সুখী আছি। খুব সুখী আছি।
শুধু আমাদের মেয়ে সায়রি একবার জানতে চেয়েছিল, “বাবা, আমার মামনি বাকীদের থেকে আলাদা কেন?”। তখন আমি সায়রির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বলি, “তোমার মা বাকীদের থেকে আলাদা, কারণ বাকীদের মত ও অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেনি। প্রতিবাদ করেছিল।”
(লেখা – সায়ন বসু মল্লিক)